দেওয়ানী মামলার ধাপ সমূহ না জানার কারণে অনেকে বিভিন্ন প্রকার হয়রানির শিকার হয়। তাই দেওয়ানী মামলার ধাপ সমূহ জানা অত্যান্ত জরুরি। আবার অনেকে ভূলবসত দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলা মামলার
প্রক্রিয়া সমূহ একই মনে করে থাকেন। কিন্তু দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলা মামলার প্রক্রিয়া সমূহ ভিন্ন। ১৯০৮ সালের দেওয়ানী কার্যবিধির ৯ ধারা অনুযায়ী দেওয়ানী প্রকৃতির মামলা বলতে ঐ ধরণের মামলাকে বুঝায় যখন মামলার প্রধান প্রশ্ন সম্পত্তি বা পদের অধিকার সংক্রান্ত হয়। দেওয়ানী মামলার বিচার প্রক্রিয়া পরিচালিত হয় দেওয়ানী কার্যবিধি ১৯০৮ আইনের ১৫৮ টি ধারা ও ৫১ টি আদেশ এর মাধ্যমে। দেওয়ানী মামলার ধাপ সমূহ নিম্নে আলোচোনা করা হলো।
দেওয়ানী মামলার বিভিন্ন ধাপ সমূহ
মামলা দায়ের
দেওয়ানী মামলা মামলার প্রক্রিয়া শুরু হয় এখতিয়ার ভুক্ত আদালতের সেরেস্তাদারের নিকটে আরজি দাখিলের মাধ্যমে । আরজীর সাথে প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র দাখিল করতে হবে। এর সাথে ডাক টিকেটযুক্ত সমন-নোটিশ ও প্রয়োজনীয় কোর্ট ফি দাখিল করতে হবে। যথাযথ ভাবে মামলা ফাইলিং হলে সেরেস্তাদার মামলার ফাইলিং রেজিষ্ট্রারে মামলার পক্ষগণের নাম, মামলার ধরন , মামলার নম্বর ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করবে।
সমন ইস্যু
মামলা যথাযথ ভাবে দায়ের করা হলে আদালত সকল বিবাদীর উপর সমন জারী করবে। আদালত থেকে সকল বিবাদীর উপর সমন জারী করার উদেশ্য হলো তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে সে সম্পর্কে তাকে অবহিত করা, নিদিষ্ট তারিখে আদালতে হাজির হওয়া এবং তার স্বপক্ষে জবাব দাখিল করার জন্য নিদ্দেশ প্রদান করে থাকে । আদালত থেকে সমন জারীকারক নিজে সমনের একটি কপি বিবাদীকে প্রদান করবেন এবং একটি সমনের বিপরীত পৃষ্টায় যাহার উপর সমনজারী হয়েছে তাহার স্বাক্ষর সম্ভলিত একটি কপি আদালতে দাখিল করবেন । এছাড়াও আদালত বিভিন্ন ভাবে বিবাদীর উপর সমন জারী করতে পারে ।
লিখিত জবাব দাখিল
বিবাদীর উপর সমন যথাযথ ভাবে জারী করা হলে সমনে উল্লেখিত দিনে হাজির হয়ে বিবাদী তার স্বপক্ষে জবাব দাখিল দাখিল করবেন। ১৯০৮ সালের দেওয়ানী কার্যবিধির, আদেশ -৮, বিধি-১ অনুযায়ী বিবাদীর প্রতি যথারীতি সমন জারী অথবা মামলার ১ম শুনানীর তারিখ থেকে দুই মাসের মধ্যে বিবাদীকে লিখিত জবাব দাখিল করতে হবে । তা না হলে মামলাটি একতরফা শুনানীর জন্য নির্ধারিত হবে। বিবাদী যদি যথা সময়ে লিখিত জবাব দাখিল করতে না পারেন তাহলে বিবাদী তার লিখিত জবাব দাখিল করার জন্য আদালতে সময়ের আবেদন করতে পারবে। বিবাদী যদি লিখিত জবাবে তার দাবীর সমর্থনে কোন দলিলাদির উপর নির্ভর করে, তবে তা ফিরিস্তি সহকারে ঐ দলিলাদি লিখিত জবাবের সাথে আদালতে দাখিল করবেন।
একতরফা শুনানী
কোন বিবাদী যদি নির্ধারিত সময়ের ভিতরে লিখিত জবাব দিতে না পারেন বা আদালতে উপস্থিত না হন তাহলে আদালত মামলা একতরফা শুনানী করবেন। পরবর্তীতে আদালত একতরফা সাক্ষ্য গ্রহন করে বিরোধীয় বিষয়ে বিবাদীগনের দাবী নেই মর্মে ধরে নিয়ে মোকদ্দমাটি একতরফাভাবে নিষ্পত্তি করবেন । ।যদি বিবাদী জবাব দাখিল করেন তবে আদালত মামলাটিকে নিম্নে বর্নিত ধাপে অগ্রসর হবেন।
বিকল্পভাবে বিরোধ নিষ্পত্তি (ADR):
বিবাদী তার লিখিত জবাব দাখিল এর পর যদি উভয় পক্ষ আদালতে উপস্থিত থাকে তাহলে আদালত মামালার শুনানী মুলতবী করে ১৯০৮ সালের দেওয়ানী কার্যবিধির ৮৯ক বা ৮৯খ ধারা অনুযায়ী উভয় পক্ষের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আদালতের বাহিরে মধ্যস্থতার মাধ্যমে সমাধান করার চেষ্টা করবেন।
ইস্যু বা বিচার্য বিষয় নির্ধারন
উভয়পক্ষ যদি আদালতের বাহিরে মধ্যস্থতার মাধ্যমে তাদের বিরোধ নিষ্পত্তি করতে ব্যার্থ হন তাহলে আদালত মামলার পরবর্তী কার্যক্রম শুরু করবেন। ইস্যু গঠন বা বির্চার্য বিষয় হলো কোন বিষয়ের উপর মোকদ্দমাটি বিচার হবে তা নিধারর্ণ করা। ১৯০৮ সালের দেওয়ানী কার্যবিধির আদেশ-১৪, বিধি-১ অনুযায়ী মামলার প্রথম শুনানীর তারিখ হতে বা জবাব দাখিলের মধ্যে যেটি পরে সেদিন থেকে ১৫ দিনের মধ্যে ইস্যু গঠন করতে হবে।
৩০ ধারায় পদক্ষেপ
আদালত যে কোন সময় স্বতঃ প্রবৃত্ত হয়ে অথবা কোন এক পক্ষের আবেদনক্রমে- প্রশ্নাবলী সরবরাহ ও জবাব দান , দলিল ও তথ্য গ্রহন এবং সাক্ষ্য হিসেবে দাখিলযোগ্য দলিল বা অন্য কোন বস্তু আবিষ্কার, পরিদর্শন,দাখিল বা ফেরৎ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় আদেশ দিতে পারেন । এছাড়া যার স্বাক্ষ্য দেওয়ার জন্য বা উপরোক্ত দলিলাদি উপস্থাপনের জন্য যার উপস্থিতি প্রয়োজন তার প্রতি আদালত সমন ইস্যু করতে পারেন এবং কোন ঘটনা হলফনামাযোগে প্রমাণের আদেশ দিতে পারেন।
চুড়ান্ত শুনানীর জন্য তারিখ নির্ধারণ ( এস ডি)
৩০ ধারার পদক্ষেপ এর পর আদালত মামলার চুড়ান্ত শুনানীর জন্য তারিখ নির্ধারণ করবেন। দেওয়ানী কার্যবিধি- ১৯০৮ এর আদেশ -১৪ বিধি ৮ অনুযায়ী ইস্যু গঠনের ১২০ দিনের মধ্যে মামলার চূড়ান্ত শুনানীর দিন ধার্য করতে হয়। পক্ষদ্বয়কে তাদের নিজ নিজ পক্ষে মামলা প্রমানের জন্য সাক্ষীর তালিকা না দিয়ে থাকলে তাহলে আদালত সাক্ষীদের তালিকা দিতে বলবেন ।
চুড়ান্ত শুনানী (PH)
এই পর্যায়ে আদালত উভয় পক্ষের সাক্ষীগনদের জবানবন্দী লিপিবদ্ধ করবেন। একপক্ষের সাক্ষীকে অপর পক্ষের নিযুক্ত আইনজীবী জেরা করবেন এবং আদালত তাহা লিপিবদ্ধ করবেন । কোন প্রকারের দালিলিক সাক্ষ্য থাকলে পক্ষগন তাহা আদালতে উপস্থাপন করবেন । প্রথম যেদিন চুড়ান্ত শুনানী শুরু হবে সেটি হচ্ছে Peremptory Hearing বা PH
অধিকতর শুনানী বা (FPH)
দেওয়ানী কার্যবিধি- ১৯০৮ এর আদেশ -১৮ বিধি ১৯ অনুযায়ী চূড়ান্ত শুনানীর তারিখ হতে ১২০ দিনের মধ্যে মামলার শুনানী শেষ করতে হয়। আদালত যদি প্রথম দিনে মামলার সকল সাক্ষীর জবানবন্দী -জেরা ও দালিলিক সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করতে না পারলে পরবর্তীতে আদালত অধিকতর শুনানীর জন্য তারিখদিবেন এটাকে FPH বলে হয়ে থাকে।
যুক্তিতর্ক
মামলার শুনানী,উভয় পক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহন, জেরা করার পর বাদী-বিবাদীর নিযুক্ত আইনজীবী তাদের পক্ষে আদালতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবেন। মোকদ্দমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল বিষয় সংক্ষিপ্ত আকারে আদালতের সামনে উপস্থাপন করবেন । যুক্তিতর্ক অবশ্যাই স্পষ্ট,আইনসম্মত হতে হবে । যুক্তিতর্ক শেষে আদালত রায় ঘোষণার জন্য তারিখ নির্ধারণ করবেন।
রায় ঘোষণ
সাধারণত যুক্তিতর্ক শুনানির পর আদালত একটি নিদিষ্ট তারিখে মামলার রায় ঘোষণা করবেন। দেওয়ানী কার্যবিধি- ১৯০৮ এর আদেশ -২০ বিধি ১ অনুযায়ী মামলা শুনানী সমাপ্ত হওয়ার পরে অনধিক ৭ দিনের মধ্যে আদালত রায় ঘোষণার কথা বলা হয়েছে । রায়ের মধ্যে পক্ষগনের বক্তব্যের সংকিপ্ত বিষয়বস্তু, বাদী -বিবাদীর সাক্ষীর জেরা- জবানবন্দীর বিশ্লেষণ ,বিচার্য বিষয়, সিন্ধান্ত সম্পর্কে যুক্তি সঙ্গত আলোচনা,সর্বশেষ আদেশ ইত্যাদি ধারাবাহিক ভাবে লিপিবদ্ধ থাকবে।
ডিক্রি প্রদান:
দেওয়ানী কার্যবিধি- ১৯০৮ এর আদেশ -২০ বিধি- ৫(a) অনুযায়ী আদালত রায় ঘোষণার পরবর্তী সাতদিনের মধ্যে ডিক্রি প্রস্তুত করবেন ।
ডিক্রি জারী
দেওয়ানী কার্যবিধি- ১৯০৮ এর আদেশ -২১ অনুযায়ী ডিক্রি জারী জন্য আদালতে দরখাস্ত করতে পারেন । মোকদ্দমায় আদালত ডিক্রি প্রদান করলে নিধার্রিত সময়ের মধ্যে ডিক্রি কার্যকর করার জন্য নিদের্শনা থাকলে তদানুসারে বিবাদী ডিক্রি কার্যকর না করে থাকলে বাদী ডিক্রি জারীর জন্য আদালতে দরখাস্ত করতে পারেন ।
রিভিউ
দেওয়ানী কার্যবিধি- ১৯০৮ এর ধারা ১১৪ অনুযায়ী মোকদ্দমার বিচারকালে গুরুত্বপূর্ণ দলিলাদি সম্বন্ধে পক্ষগন আদালতকে অবগত করতে ব্যর্থ হলে বা উক্ত দলিল সমূহ মামলার নথীতে থাকা স্বত্তেও ভুলবশত বিচারে প্রমাণ না হলে বা অন্যকোন সঙ্গত কারণে ন্যায় বিচার ব্যাহত হলে সংক্ষুদ্ধ পক্ষ রায়টি রিভিউ করার জন্য রায় প্রচারকারী আদালতে আবেদন করতে পারেন ।
রিভিশন
নিম্ন আদালতের রায়ে মামলার যেপক্ষ সংক্ষুদ্ধ হবে বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেই পক্ষ উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আইন দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দেওয়ানী কার্যবিধি- ১৯০৮ এর ধারা ১১৫ অনুযায়ী রিভিশন করতে পারেন। রিভিশন আদালত শুনানী অন্তে নিম্ন আদালতের রায় বহাল বা বাতিল করতে পারেন ।
আপীল
নিম্ন আদালতের রায়ে মামলার যেপক্ষ সংক্ষুদ্ধ হবে বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেই পক্ষ উক্ত রায়ের বিরুদ্ধেউচ্চ আদালতে আইন দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দেওয়ানী কার্যবিধি- ১৯০৮ এর ধারা ৯৬ অনুযায়ী আপীল করতে পারেন। আপীল আদালত শুনানী অন্তে নিম্ন আদালতের রায় বহাল বা বাতিল করতে পারেন । এগুলো হলো দেওয়ানী মামলার ধাপ স্তর সমূহ । এছাড়াও দেওয়ানী আদালতে মামলা চলাকালীন সময়ে পক্ষগনের আবেদনের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন প্রকারের দরখাস্তর আবেদন করতে পারেন।
সিএলপি কর্তৃক আইনী সেবা:
সিএলপি একটি সনামধন্য ‘ল’ চেম্বার এখানে ব্যারিস্টারস ও আইনজীবীর মাধ্যমে দেওয়ানী মামলা সহ অন্য সকল বিষয়ে আইনগত সহায়তা, পরামর্শ প্রদান করে থাকে। কোন প্রশ্ন বা আইনী সহায়তার জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করুনঃ-ই-মেইল: info@counselslaw.com ফোন: +8801700920980 +8801947470606, ঠিকানা: জামিলা ভি লা, ফ্ল্যাটঃ সি-২, বাসা-৪/এ/১ (তৃতীয় তল), রোড-০২, গুলশান ১, ঢাকা-১২১২।